হাসান মামুনঃ
বাংলার ঐতিহ্যকে বিশ্বে তুলে ধরার মাধ্যমে মৃৎ শিল্পকে জীবন্ত করে তোলা সম্ভব বলে মনে করেণ মৃৎশিল্প পরিবারের কর্তারা। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও বহমাত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মৃৎশিল্প রপ্তানী করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের অপার সম্ভবনা। গেল প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আধুনিক পটারি মেশিন ও সরঞ্জাম পেয়ে দৈনিক শ্রমের লাঘব ঘটিয়েছে জেলা প্রশাসন। যেখানে “মাটি পা দিয়ে ছানতে হত। এখন সকাল থেকে রাত অবধি পটারি মেশিন দিয়ে মাটি ছেনে তৈরীকৃত জিনিসপত্র পলিথিনের মোড়কে প্যাকেটজাত করা, রোদে শুকান, রং করা, ডিজাইন করা, রং ম্যাচ করা, পাইকারদের সরবরাহ করা ও পুটিংয়ের কারুকার্য সম্পাদন করায় মহা ব্যাস্ত থাকেন তারা। মূলত শুকনো মৌসুমে মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে বেশি ব্যস্ত থাকেন মৃৎশিল্পীরা বেশি।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার ১নং সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নের সোনাকুর গ্রামের প্রায় শতাধিক পাল সম্প্রদায়ের লোকজন মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িয়ে ছিল কিছু হিন্দু পরিবার। তারা এলাকায় কুমার বা পাল নামেও অধিক পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে হাতে গোনা কয়েক জন বাপ-দাদার পেশা আকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তারক পালের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল তার স্ত্রী অঞ্জলী ও ছেলে লক্ষণ পাল মায়ের কাজে সহায়তা করছে। কিছু মৃৎ শিল্পী এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, কেউ তাদের খোঁজ-খবর নেয় না, কেউ জানতে চায় না, তাদের সুখ-দুঃখের খবর। তবে আমাদের সোনাকুর গ্রামের ২৫ টি পরিবার রয়েছে। এদের মধ্যে ৪টি পরিবারকে আধুনিক পটারি মেশিন দিছেন জেলা প্রশাসন। কয়েকজন মৃৎশিল্পী বলেন, সরকার থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেলে তাঁরা হয়তোবা এ পেশা চালিয়ে যেতে পারবেন বলে দাবি করেন। স্থানীয় বাজারে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের এখন আর তেমন চাহিদা নেই তবে ঐতিহ্যকে বিশে^ তুলে ধরার মাধ্যমে মৃৎ শিল্পকে জীবন্ত করে তোলা সম্ভব বলেও জানিয়েছে সোনাকুরের কুমার সম্প্রদায়েরা।
পরিবারের কর্তারা জানালেন, স্বাধীনতার প্রায় ৫১ বছরে দেশের অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি মৃৎ শিল্পের। প্রয়োজনীয় অর্থভাবে কুমার পরিবার গুলোর নেই কোন আধুনিক মেশিন ও সরঞ্জাম। আমাদের দেশের এটেল মাটি দিয়ে ছোট ছোট ইট, কারুকার্য খচিত ছোট বড় ফুলের টব, ঘরের রঙ্গীন টালি বা ছাউনি, মাটির তৈরি রকমারি চায়ের কাপ, ভাপাপিঠা তৈরির কাজে ব্যবহৃত খাঁজ, কয়েল দানি, হাঁড়ী-পাতিল, কলষি, গরুর খাবার পাত্র, ধান-চাল রাখার বড় পাত্র, পাতিল, ব্যাংক, চুলা, আম, কাঁঠাল, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বাঘ, হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, হাতী, ঘোড়া, গরু, পুতুল, মাছ, মোরগ, কুমড়া গামলা, কুপি বাতি, থালা, যাতা, দুধের পাত্র, কলকি, কড়াই, শিশুদের জন্য রকমারি নকশার পুতুল, খেলনা ও মাটির তৈরি পশু-পাখি ইত্যাদি সহ মৃৎ শিল্প তৈরী করতে প্রধান উপকরণ হচ্ছে এটেল মাটি, জালানী কাঠ, শুকনো ঘাস ও খড়।
কুমার সম্প্রদায়ের তৈরীকৃত নানা ধরনের খেলনা সামগ্রী হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাটির জিনিস তৈরি করে রোদে শুকিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে ব্যবহার যোগ্য করে সেগুলো জেলা-উপজেলার গ্রাম-গঞ্জে, হাট বাজারে বিক্রি করা হয়। এক সময় মাটির তৈরি ও বহুমাত্রিক ব্যবহারের এ শিল্পটির প্রায় সকল মহলেই কদর ছিল। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এ শিল্পের মালামাল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও সরবরাহ করা হত। গরিব থেকে শুরু করে নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এর কদর ও ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মত। জেলায় মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত কুমার পরিবার গুলো সূর্য উঠার সাথে সাথে কুমাররা মাটি দিয়ে তৈরি পাতিলের বোঝাই ভার নিয়ে দলে দলে ছুটে চলত প্রতিটি গ্রাম ও মহল্লায়। মাটির তৈরি জিনিস নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে এবং পণ্যের বিনিময়ে ধান সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় ধান বোঝাই ভার নিয়ে ফিরে আসতো। ওই সব ধান বিক্রি করে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনত। কিন্তু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগীতার অভাবে আজ এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।
মৃৎশিল্পী স্বপন পাল বলেন, এ শিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। তারা জানায়, হাড়ি-পাতিল ও অন্য সব জিনিস পত্র তৈরি করতে কাঁচা মাল এঁটেল মাটি আমাদের গ্রামের পাশর্^ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী থেকে সংগ্রহ করা যেত। বর্তমানে নদী ভরাটের কারণে নদী থেকে আর মাটি তোলা হয় না। তাই পাশের গ্রাম থেকে টাকার বিনিময়ে মাটি কিনে আবার ভ্যান যোগে আনতে হয়। মৃৎশিল্পী শংকর পাল ও রাখাল পাল বলেন, বাপ দাদার পেশা বদলাতে পারছিনা, তাই আকড়ে ধরে আছি। “সারা বছর মাটির হাড়ি, পাতিল, কলস সহ বিভিন্ন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। তবে ভাল দাম না পাওয়ায় আমাদের সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হয়। আর্থিক সংকটসহ নানা অভাব অনাটনে, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মৃৎ শিল্প থেকে।
মৃৎ শিল্পী রমেল পাল জানালেন, “মাটি মিশ্রিতকরা মানুষ দিয়া (এটা পা দিয়ে ছানে) প্রতিদিন ৪‘শ থেকে ৫‘শ টাকা ভারায় (নৌকায়) দিতে হয়। যদি মেশিন থাকত তা হলে ভাল হইত। সেই মাটি দিয়ে কলস তৈরী করি, প্রতিটি কলস বিক্রি করি ২০ থেকে ২৫ টাকায়, একটি মিস্টির পাতিল বিক্রি করি ১০ টাকা। এখন ক্রেতারা এসে দাম বলে ৮ টাকা। আগের চেয়ে দাম কমে গেছে বিভিন্ন প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য বের হয়ে মালের দাম কমে গেছে। ফুলের টব আগে বিক্রি হত ৫ টাকা। এখন এসে ক্রেতারা বলে ৪ টাকা। এই টাকায় বিক্রি করতে হবে কারন, আমাদের সংসার চালাতে হবে। এই কাজ ছাড়া যাবে না এটাই আমাদের পৈত্রিক ব্যবসা। পাইকারী মিস্টির পাতিল বিক্রি করি ৮ টাকা, কলসি ৩ আইটেম আছে ২০, ২৫ ও ৩০ টাকা পাইকাররা এই দামে কিনে নেয়। সাইজ অনুসারে বিক্রি হয় ফুলের টব ১০, ২০ ও ৩০ টাকা। আমাদের জমি-জমা কোন ফসল ওঠবে, এমন কোন ধানের জমি নাই। আমরা হাতে রথে খেটে চলছি এখন আমারা যে, দু‘টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। ধার-দেনা হচ্ছি। ঋণ নিয়ে এখানকার টাকা ওখানে এইভাবে চলতে আছি। চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখে প্রতিবছর পিরোজপুরের মৃৎশিল্পীদের সময় কাটে মাটির জিনিসপত্র তৈরি ও বিক্রিতে।
এদিকে জেলা শহরের দামোদর নদের উত্তর পাশে পাল সম্প্রদায়ের অসংখ্য পরিবারে মাটির তৈরী নানা ধরনের প্রস্তুতকৃত খেলনা সামগ্রী বিভিন্ন যায়গায় সরবরাহ করতেও ব্যাতি-ব্যাস্ত হয়ে উঠেছেন তারা। তবে তারা যথেষ্ট শঙ্কিত এ কারনে, বাজারে রং ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বাড়তি থাকায় তাদের উৎপাদিত পন্যের আসল দাম ঘরে তুলতে পারবেন কি-না তা নিয়ে। পিরোজপুর সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মূলগ্রাম। এ গ্রামের সড়কের পাশে এক বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত পালপাড়া। দুইশত বছরের পুরনো পালপাড়ায় বর্তমানে ১৫০টি পরিবার বসবাস করছে। প্রতিটি পরিবার মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পালপাড়ায় গেলে এখনো মাটি দিয়ে তৈজসপত্র তৈরি করতে দেখা যায় নারী ও পুরুষ মৃৎ শিল্পীদের। চাকা ঘুরিয়ে মাটির টালি, ফুলের টব, বাসন, চিতই পিঠার সাজ এসব তৈরি করছেন। রোদে শুকানো হচ্ছে মাটির তৈরি পাত্রগুলো। রোদে শুকানোর পর সেগুলো পোড়ানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। আর স্থানীয়ভাবে তৈরি জিনিসপত্রগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ক্রেতারা তাদের কাছ থেকে কিনে নেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, সোনাকুর গ্রামের মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িতদের মাঝে পটারি মেশিন ও সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে এ মিশন বৃদ্ধি করা যায়।