সেবা ডেস্কঃ বাংলাদেশে অতি বিপন্ন শকুনের সংখ্যা মাত্র ২০০, আর এর মধ্যে পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা মোল্লাপাড়া গ্রামেই আছে ১২টি। প্রায় ৩০ বছর ধরে দলবেঁধে বসবাস করছে এসব শকুন। এরা কখনো উঁচু দেবদারু, পুরোনো তেঁতুল গাছে, কখনো নারকেল গাছেও দলবেঁধে বসে থাকে।
ফরেস্ট বিভাগের তথ্য থেকে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইইউসিএন বাংলাদেশ ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে শকুন রক্ষায় একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল। তাদের এক জরিপে ২০১৬ সালে সারা দেশে দুই শতর মতো শকুন ছিল বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সিলেটে শকুনের সংখ্যা ছিল একশর মতো, এগুলো মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বনাঞ্চলে থাকে। বাকি অর্ধেক সুন্দরবনে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে আছে।
পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইইউসিএন এই শিকারি প্রজাতির শকুনকে ‘বিশ্ব মহাবিপন্ন’ বলে ঘোষণা করেছে। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। এর মধ্যে চার প্রজাতির শকুন এদেশের অনিয়মিত আগন্তুক। প্রজাতিগুলো হলো- ইউরেশীয়-গৃধিনি, হিমালয়ী-গৃধিনি, ধলা শকুন এবং কালা শকুন। বাকি তিন প্রজাতি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। এগুলো হলো- বাংলা শকুন, সরসঠুঁটি শকুন ও রাজ-শকুন। গত প্রায় ৪৫ বছরে সরসঠুঁটি-শকুন ও রাজ-শকুন বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন অল্প কিছু ‘বাংলা শকুন’ বেঁচে আছে, মহাবিপন্নের তালিকায়। এরা ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে পশুচিকিৎসায় বেদনার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ‘ডাইকোফেন’। ডাইকোফেনের বিকল্প হিসেবে যে ‘কিটোপ্রোফেন’ ব্যবহার করা হয়, তাতেও শকুন মারা যায়। ওইসব ওষুধ খাওয়া মৃত পশু খেয়ে মারা যাচ্ছে শকুন। ফলে দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে শকুনের সংখ্যা।
তবে পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার চাকলা মোল্লাপাড়া গ্রামের প্রফেসর আবদুল মালেকের একটি বসতিহীন বাগানে দেবদারু ও তেঁতুল গাছে এবং আজগার মোল্লার বসতিহীন বাগানের নারকেল গাছে বাসা বেঁধে আছে শকুনগুলো। বাচ্চাও ফোটায় শকুন পাখিগুলো। এই দুটি বাগানে অনেক পুরোনো বেশকিছু উঁচু গাছ থাকায় প্রায় ৩০ বছর ধরে এই শকুনের দল বসবাস করে আসছে।
সরেজমিনে বুধবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, মালেক প্রফেসরের ভিটায় থাকা পুরোনো দেবদারু গাছে চারটি শকুন ও তেঁতুল গাছে তিনটি শকুন বসে আছে। এছাড়া আজগার মোল্লার ভিটার নারকেল গাছে থাকা বাসায় একটি ও ডাগুরে দুটি শকুন বসে থাকতে দেখা যায়। এরা সকালে খাবারের খোঁজে বের হয় এবং বিকেল চারটার মধ্যে আবার বাসায় ফিরে আসে বলে জানা যায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই চাকলা মোল্লা পাড়া গ্রামে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এই শকুনের দল বসবাস করছে। মাঝে মধ্যে উঁচু গাছ থেকে শকুনের বাচ্চা পড়ে গেলে গ্রামের দুষ্টু ছেলেমেয়ের দল বিরক্ত করে, এমনকি মেরেও ফেলে। কয়েকটি বড় শকুন মারা গেছে।
পার্শ্ববর্তী সাঁথিয়া উপজেলার পুন্ডুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র আরমান (১৭) সহ তার কয়েকজন সহপাঠী এ প্রতিবেদককে জানায়, আমরা শকুন দেখিনি। টেলিভিশনে ও মোবাইলে দেখেছি।
উপজেলার চাকলা মোল্লাপাড়া গ্রামের আজগার মোল্লা বলেন, আমাদের পুরোনো ভিটার গাছে প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে একটি শকুনের দল বাসা বানিয়ে থাকছে। তিন চার বছর আগে একবার আমাদের নারকেল গাছের ডাগুর কাটতে গেলে সেই গাছে থাকা শকুনের বাসা থেকে একটি বাচ্চা পড়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনোদিনই ওই নারকেল গাছ পরিষ্কার করা হয়নি। এখনো ওই নারকেল গাছে শকুনের বাসা আছে। সেখানে ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফুটায় তারা।
বেড়া উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক জানান, ‘বাংলা শকুন’ আর কোথাও দেখা যায় না। তবে বেড়া উপজেলা চাকলা গ্রামে এই বাংলা শকুনের একটি দল বসবাস করছে বহু বছর ধরে। আমি ওই এলাকায় কয়েকবার স্থানীয়দের কাছে শকুনের উপকারিতা, গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছি। পাশাপাশি শকুনগুলোকে বিরক্ত না করার জন্যও বলেছি। শকুন রক্ষার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় কর্মকর্তা বন্যপ্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির জানান, প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত শকুন একবারেই বিলুপ্তির পথে। তবে আমার জানা তথ্যমতে, রাজশাহী বিভাগের বেড়া ব্যতীত আর কোথাও এই বাংলা শকুনের বসবাস নেই। যেসব প্রাণী মরে রোগজীবাণু ছড়ায়, সেসব প্রাণী খেয়ে হজম করে শকুন। অস্বাভাবিক হারে শকুন কমে যাওয়ায় দেশে এখন অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্কসহ নানা রোগের প্রার্দুভাব বেড়ে যাচ্ছে। শকুনের আবাসস্থল ও খাদ্যের নিরাপত্তা দিতে হবে। তিনি আরো জানান, আপনার দেওয়া ছবি দেখে বুঝতে পেরেছি এটা বাংলা শকুন। আমি ওই ছবি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে দ্রুত চাকলা মোল্লাপাড়া এলাকা পরিদর্শন করব।