হাসান মামুন :
ভরাট হয়ে নালায় পরিণত হয়েছিল খালগুলো। পাড়ে গাছ-গাছালি ও লতাপাতায় হাঁটা যেত না। অনেক স্থানে জোয়ার-ভাটার পানি আসা-যাওয়া ছিল বন্ধ। এতে খালের পাশে আবাদি অনেক জমি জলাবদ্ধতায় অনাবাদি হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। খালগুলো খননের মাধ্যমে প্রশস্ত করা হয়েছে। দুই পাড়ে মাটি দিয়ে বাঁধায় করে তৈরি করা হয়েছে হাঁটার রাস্তা। সহজে জোয়ার-ভাটার পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা শ্রীরামকাঠীতে ৯টি খালের প্রায় ১১ দশমিক ৯২৫ কিলোমিটার খননে এই চিত্র বদলে দিয়েছে। সরকারের সুদূরপ্রসারী টেকসই ও মেগা বিভিন্ন প্রকল্পের চলমান কার্যক্রমে দিন বদলের পালায় বদলে গেছে পিরোজপুর।
সরেজমিনে, পিরোজপুরের উত্তরের উর্বর জমি সমৃদ্ধ জনপদের নাম নাজিরপুর উপজেলা। ফুল ফল আর ফসলী জমির জন্য অত্র উপজেলাটির রয়েছে ব্যপক পরিচিতি। এখানে সূর্যমুখী ফুল আর মাল্টা চাষের রয়েছে যেমন সুখ্যাতি, তেমনি রয়েছে মৎস্য চাষ, ভাসমান সব্জির বেড ও ভাসমান সব্জি কেনা-বেঁচার উপযোগী পরিবেশ।
পিরোজপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ১৫ কি:মি: দূরত্বে নাজিরপুর উপজেলার অবস্থান। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নেই বিভিন্ন ফসলাদি উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ইউনিয়নে শুকনো মৌসুমে পানির আধাঁর হ্রাস পাওয়ায় আউষ ও বোরো ফসলসহ বিভিন্ন ফসল আবাদে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন গ্রামের ভেতর থেকে বয়ে যাওয়া প্রধান খাল ও শাখা খালগুলোর অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ায় পানিপ্রবাহ হ্রাস পেয়েছে, ফলে প্রতিবছর শতশত একর ফসলী জমি অনাবাদিসহ কৃষকরা সেচ দিতে না পারায় ফসল উৎপাদনে বড় ধরনের মার খাচ্ছেন। নাজিরপুর উপজেলায় (এবছর) চলতি মৌসুমে ১৩ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে।
নাজিরপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌল বিভাগ জানায়, অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন খালের নাব্যতা সঙ্কটের ফলে পানি সেচ ব্যাবস্থাপনায় কৃষকরা তাদের আবাদি ফসল উৎপাদনে কাঙ্খিত সাফল্যধরে রাখতে পারছেননা। পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিমের নির্দেশনায় এ বছর উপজেলার মোট ১ হাজার হেক্টর জমির অভ্যন্তরিন ১১ দশমিক ৯২৫ কি:মি: খাল খননের কার্যক্রম গ্রহন করা করা হয়েছে। যারমধ্যে ৪০ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এবং বাকী কাজ চলতি বছরের (২০২২-২০২৩) জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ কোটি, ১২ লক্ষ, ৬৮ হাজার টাকা।
এলজিইডি নাজিরপুর উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জাকির হোসেন জানান, উপজেলার শ্রীরামকাঠি ইউনিয়নের জয়পুর, ভীমকাঠি ও কালিকাঠি গ্রামে এজন্য ৯টি খাল খননের কাজ চলমান রয়েছে। সম্পুর্ন কাজ শেষ হলে মোট জমির ৭শ’ ৯০ হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত ৩০ ভাগ বোরোসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হবে। একই সঙ্গে খালের প্রবাহিত পানির সঙ্গে পলি এসে জমির উর্বরাতা বৃদ্ধিসহ সেচ কাজে আসবে গতিশীলতা এবং বাঁচবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাবহার।
এই গ্রামে বসবাস কৃষান মানিক বড়াল (২৪), শ্যামল মিস্ত্রি ও পরোশ মিস্ত্রি (৫৫) এবং কৃষানি শিখা রানী বড়াল (৫৫) জানান, আমাদের এলাকার জমি খুবই উর্বর হওয়ায় এই জমিতে রবী শষ্যের ভালো ফলন হতো। কিন্তু পুকুর, খাল থেকে জমিতে পানির জন্য বসানো হয়েছে বড় বড় পাইপ। অন্যদিকে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় অনা বৃষ্টিতে মধ্যে পড়তে হতো আমাদের। খালটি সংস্কার না থাকায় দীর্ঘদিন থেকে জোয়ার ভাটার পানি চলাচল করে না। খালের দুই পাড়ের পাশের জমি গুলো অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকতো। আমরা নিজেদের জমি বিক্রি করতে চাইলেও ভালো মূল্য পেতাম না। সম্প্রতি খাল খননের জন্য এলাকাবাসির দাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর নির্দেশনায় এ বছর খাল খননের কার্যক্রম গ্রহন করা করা হচ্ছে বলে উপকারভোগীরা জানান।
স্থানীয় নাগরিক ও উপকারভোগী এস এম রোকনুজ্জামান জানান, গ্রামীন জনপদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভরাট খালগুলো উদ্ধার করে খনন ও পুনঃখনন করা হলে একদিকে যেমন খালের নাব্যতা ফিরে আসবে, তেমনি ফসলের রেকর্ড পরিমান উৎপাদন বাড়বে এমনটাই মনে করছেন সংম্লিষ্টরা।
শ্রীরামকাঠি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন বেপারী জানান, বড় খালগুলো অনেক দুরে হওয়ায় জোয়ার ভাটার পানি চলাচল হতো না এই খাল দিয়ে। এতে বর্ষায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে খালের দুই পাশে শত শত একর জমি আনাবাদী থেকে যেত বর্ষায় গ্রামের কাচা রাস্তাগুলো ডুবে থাকত পানিতে। মাঝে মাঝে জমি থেকে খালে পানি নামার জন্য বসানো হয়েছে বড় বড় পাইপ। খালে পাড়ে জমির মালিকরা শিম, লাউসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছে। এই খালটি খননের মাধ্যমে পাল্টে গেছে পুরো গ্রামের চিত্র।