হাসান মামুন : পশ্চিমে কপোতাক্ষ আর পূর্বে শাকবাড়িয়া নদী। এরও পূর্বে নয়নাভিরাম সুন্দরবন। দু’দিকের নদী বেষ্টিত ওই এলাকাটি উপকূলবর্তী খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের আওতাধীন। কয়রা সদর থেকে একটু দক্ষিণে গিয়ে কাটকাটা লঞ্চঘাট থেকে শুরু করে বীনাপানি, হরিহরপুর, গাতির ঘেরি হয়ে অনেকটা দ্বীপের ন্যায় ওই এলাকাটি চলে গেছে একেবারে দক্ষিণ বেদকাশী। মাঝপথে কপোতাক্ষ-শাক বাড়িয়া নদীর মিলনস্থল হয়ে আবারো দক্ষিণে বয়ে গেছে পৃথক হয়ে। নদীবেষ্টিত ওই এলাকার মানুষের জীবন চলে অনেকটা সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সাথেই তাদের বেড়ে ওঠা। পানি যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। হালে কয়েক মাস একটু শুকনো থাকলেও সেখানকার মানুষের সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি থাকে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তাদের একমাত্র ভরসা থাকে রাস্তা ও নৌকা। প্রায় প্রতিটি ঘরেই একটি বা দু’টি করে নৌকা রয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই নৌকা চালানোয় পারদর্শী। নৌকা নিয়েই নদীতে মাছ ধরা, সুন্দরবন থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ করে রান্নার কাজ তাদের যেন নিত্যদিনের চিত্র। অনেকে আবার নদীর পাশে চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকেন পানিতে ভেসে আসা কোন একটি মরা গাছ, ডালপালা বা পাতার অপেক্ষায়। সেগুলো সংগ্রহ করে নদীর তীরেই শুকিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করেন তারা। গাতির ঘেরির কাজল সরকার বললেন, কাঠের জন্য তাদের কোন কষ্ট নেই। এইতো সেদিন শাক বাড়িয়া নদীতে নৌকা চালাতে গিয়ে যখন সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে তিনি বজবজিয়া ফরেষ্ট ষ্টেশনের কাছাকাছি গিয়েছিলেন তখন একটি মরা কাঠ ভেঙ্গেই নৌকায় তুলছিলেন। কাঠটি পেয়েই আর হাতছাড়া করতে চাননি কাজল। এভাবেই উপকূলবর্তী মানুষের জীবন চিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের এ প্রতিবেদন।
রাস্তায়ই যাদের জীবনঃ- ১৯৮৮ সালের বন্যা থেকে শুরু করে সিডর, আইলা, আম্ফান, চিত্রাং সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ই রাস্তায় কেটে যায় জীবন এমনটি জানালেন ৭১ বছর বয়সী ভুপেন্দ্রনাথ দাস। দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের পিতা ভুপেন্দ্রনাথ দাসের এখন আর কাজের সক্ষমতা নেই। নির্ভর করেন স্ত্রী দেবলা দাসের আয়ের ওপর। নদীতে মাছ ধরেন স্ত্রী দোবলা দাস। বিক্রি করেন পাশের ফুলতলা নামক একটি জায়গায়। প্রতিদিন ৬০ থেকে সর্বোচ্চ একশ’ টাকা আয় হয়। তা’ দিয়েই চলে তাদের সংসার। ভুপেন্দ্রনাথ দাস বললেন, এক সময় তাদের প্রচুর জমি ছিল। অধিকাংশই নদীতে ভেঙ্গে গেছে। ঝড়ের সময় রাস্তায় থাকেন। বেশি পানি হলে নৌকায় চড়েন। খাবার ও হালকা মালামাল নিয়েই তারা নৌকায় উঠে পড়েন ঝড়ের সময়। এরপর পানিতেই ভেসে বেড়ান। হরিহরপুরের গাতির ঘেরি এলাকার রবীন্দ্রনাথ গাইন বললেন, ঝড়ের সময় রাস্তাই হলো সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ডিসর-আইলার পর রাস্তায়ই কেটে যায় কয়েক মাস। নদী তীরের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার চিত্রতো প্রতিনিয়তই দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তারা বাঁধ সংস্কার করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই এলাকার বাঁধটি ১৩-১৪/১ পোল্ডার হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি সেখানে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বা জাইকার অর্থায়নে নতুন করে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও ইতোমধ্যেই মাঝে-মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এজন্য জিও ব্যাগ দিয়ে ওই বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে স্থানীয় জনসাধারণ বলছেন, মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ না করা হলে টেকসই হবে না। বালু দিয়ে বাঁধ দেয়ায় এখনই দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্থানীয় তপন মন্ডল বললেন, জাইকা যে রাস্তা করেছে তাতে কিছুটা হলেও সেখানকার মানুষ নিরাপদে থাকতে পারবে। অন্তত ঝড়ের সময় রাস্তার ওপর তাবু টানিয়েও থাকা যাবে। তাছাড়া ওই বাধ দিয়ে ভেতরে পানিও প্রবেশ করতে পারবে না বলে তার আশা। কিন্তু বাঁধ টেকসই করতে প্রয়োজন মাটির বাঁধ।
বনের কাঠেই রান্নাঃ- সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা কাঠেই রান্না হয় সংসারের। তাই শাক বাড়িয়া নদী তীরেই অপেক্ষা করছিলেন পদ্মপুকুরের নুরি খাতুন। বয়সের কথা জানতে চাইলেই ‘জানিনা’ জবাব। বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ভাই-বোনদের মানুষ করতে গিয়ে আর স্বামীর বাড়ি যাওয়া হয়নি। এখনও ভাই-বোনদের সাথে থাকছেন আর এভাবেই কাঠ কুড়িয়ে সংসার চালাচ্ছেন নুরি। সরোজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায় নুরি খাতুন শাক বাড়িয়া নদী থেকে সংগ্রাহ করা কাঠ-পাতাগুলো পাশের জিও ব্যাগের ওপরই শুকাচ্ছেন। একদিন কাঠ সংগ্রহ করলে কয়েকদিন চলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এছাড়াও তিনি দিন মজুরি দিয়ে যে টাকা আয় করেন তাও সংসারে ব্যয় করেন। আইলার পর তাদের ঘর ভেঙ্গে যাওয়ায় তাবু টানিয়ে রাস্তার ওপর থাকেন প্রায় দু’বছর। পরে অনেক কষ্টে একটি ঘরেন। এখন সেই ঘরেই থাকেন তারা।
মূল সমস্যা রাস্তাঃ- ‘এই এলাকার প্রধান সমস্যা কি’ ? জানতে চাইলে স্কুল শিক্ষক দিনেশ চন্দ্র গাইনের স্ত্রী কোমলা গাইন বললেন, রাস্তা। রাস্তার কারণে ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারে না। আবার রাস্তার জন্যই অনেক সময় দ্রুত রোগী নিয়ে যাওয়া যায়না হাসপাতালে। যদিও উত্তর বেদকাশির ওই এলাকা থেকে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। শুধুমাত্র কয়রা সদরের কোন প্রাইভেট স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে রোগী নিতেও যেতে হয় ১৪/১৫ কিলোমিটার। যে পথ পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে সময় লেগে যায় ৫/৬ ঘন্টা। সড়ক পথে মটর সাইকেল ছাড়া কোন বিকল্প যান নেই। গাতির ঘেরির ভুপেন্দ্রনাথের মতে, রাস্তার পাশাপাশি মাঝে-মধ্যে গেট করা হলে ভেতরের জমে থাকা পানি নদীতে বের করা সহজ হবে। কিন্তু জাইকা যে রাস্তা করেছে তাতে কোন গেট নেই। এতে বর্ষা মৌসুমে গোটা এলাকা জলাবদ্ধতায় পরিণত হতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ওই এলাকার অনেক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে উল্লেখ করে পাইকগাছার গাওয়ালী আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল ইসলাম বললেন, তিনি বাইসাইকেল নিয়ে কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমনটিই উপলব্ধি করেছেন। সময় পেলেই তিনি এভাবে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ান বলেও জানান। সম্প্রতি ওই এলাকায়ই দেখা মেলে তার। তিনি বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, সেখানকার শিশুরা মাছ-কাকড়া ধরার কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেক বয়স করে যেমন স্কুলে ভর্তি হয়, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় অনেকেই শিক্ষা জীবন থেকে ঝড়ে পড়ে। এছাড়া নদী ভাঙ্গনের ফলে অনেক এলাকার মানচিত্র বদলে গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল বলেন, সরকারের পাশাপাশি ওই এলাকায় কিছু বেসরকারি সংস্থা অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। এটি অব্যাহত রাখা হলে মানুষের দুর্যোগকালীন কিছুটা স্বস্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য একটি এনজিও সম্প্রতি যে রাস্তা করেছে সেটিও সন্তোষজনক। এছাড়া টিউবওয়েল উঁচুকরণ ও উঁচু টয়লেট নির্মাণ করায় পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে মানুষের টয়লেটের পাশাপাশি সুপেয় পানির সংকট দূর হবে বলেও তিনি মনে করেন। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, টিউবওয়েলগুলোর স্থান নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। ক্ষেত্র বিশেষে তুলনামূলক কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় টিউবওয়েল বসানো হয়েছে বলেও তারা উল্লেখ করেন। অবশ্য বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা নতুন করে টিউবওয়েল স্থাপন করেননি। বরং আগে যেসব স্থানে টিউবওয়েল ছিল সেটি শুধুমাত্র উুঁচু করেছেন।
সার্বিকভাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকান্ড করা হলে হয়তো ভবিষ্যতে এমন প্রশ্ন থাকবে না।