সালমান পারভেজ সবুজ : রোহানের মেজাজটা যেন গড়গড় করে ফুটছে, চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। সে আজ একটু আগে বের হতে চেয়েছিল। বর্ণাকে নিয়ে বের হবে। সে গুড়ে যেন বালি ঢেলে দিলেন আরেফিন সাহেব। লোকটা যে কি করে, কোন কাজই ঠিক মত গুছিয়েই করতে পারেন না। একটা কাজ হাতে নিলে তা নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন। আর একটু পর পর আওয়াজ তুলেন। ঠিক পাড়া ডাকা মুরগী একটি আন্ডা দিয়ে যেমন ককিয়ে ডেকে পাড়া গরম করে তোলে তেমনি তাঁর স্বভাব। হাতে কাজ জিয়িয়ে রাখবেন, কোন কাজই তিনি একবারে শেষ করতে পারেন না। অন্য কাউকে সেটিতে আবার হাত দেওয়া লাগে। তার জন্যই আজ রোহানের বেরুতে দেরি হল।
সে খেয়াল করেছে যেদিন সে আগে বের হতে চাই সেদিন কোন না কোন ঝামেলা লেগেই থাকে। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না। তিনি একটি পোস্টিং ভুল করেছেন যা রিভাইজড করতে প্রধান কার্যালয়ের আইটি বিভাগের হেল্প নিতে হবে। আইটিকে আগে মেইল দিতে হবে। ম্যানেজার তাকে বলেন, রোহান সাহেব আপনি এটা একটু দেখেন। মেইলটা পাঠিয়ে দেন। রোহান না করতে পারেনি। সে মনে মনে ম্যানেজমেন্টের উপর সকল রাগ উগরে দিল। অবশ্যই তাতে কিছু আসে যাই না, সেটা সে ভালো করেই জানে। তার রাগের কারণটা ছিল ভিন্ন। সে লক্ষ্য করেছে অফিসের যারাই কোন না কোন ভাবে সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন, তারাই সবচেয়ে ফাঁকিবাজ এবং তাদের গলার আওয়াজ থাকে সবার উপরে। তাদের মধ্যে যেন গা ছাড়া ছাড়া ভাব কাজ করে। অগত্য ঢেঁকি তাকে গিলতেই হল। সে অফিস থেকে বের হয়েই একটি রিক্সায় উঠে গেল।
ঘড়ির কাটা সন্ধ্যা আটটা ছুই ছুই। হাতে সময় কম, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় ম্যাডামকে সময় দেওয়া আছে। রোহান রিক্সায় বসে ভাবছে কিভাবে ব্যাপারটা বর্ণার কাছে উপস্থাপন করা যায়। রাস্তায় ব্যস্ত নাগরিক জীবনের কোলাহল। নিত্য জ্যাম, গাড়ির হুইচেল, ঘামের মাখামাখি, কোন কিছুই তাকে টানছে না। তার ধারের কাছেও নেই। সে যেন অন্য জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে একটি অনন্য উপায়, বর্ণাকেও খুশি রেখে কাজটা শেষ করতে হবে।
তার ব্রেনের কোষ গুলি এটা নিয়ে ব্যাতিব্যাস্থ, এরই মধ্যে রিক্সা দাঁড়িয়ে গেল। লোকজনের জটলা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। আপাতত রিক্সা চলার কোন সম্ভবনা নেই। মনে হচ্ছে দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশ লোকজন জটলা পাকাচ্ছে যা হাতাহাতির পর্যায়ে। রোহান রিক্সায় বসে থাকলেও সেদিকে তার কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। হঠাৎ তার ভাবনায় যেন ছেদ পড়ে। সে ঘাড় উচিয়ে দেখার চেষ্টা করে। রাস্তার দু’পাশের ভবন থেকে অতি উৎসাহী লোকজন অধীর আগ্রহ নিয়ে যেভাবে দেখছে তাতে সে অস্বস্থি বোধ করছে, তার মনে হচ্ছে তারা সার্কাস’শো দেখছে।
একটু সামনেই সরিষাহাঁটি মোড়, মোড়ের মাথাই বাইকের সাথে ট্রাকের দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটি বাইক দাঁড়িয়ে ছিল, পিছন থেকে অটো এসে ধাক্কা মারে। বাইকওয়ালা রাস্তার উপরে পড়ে যায়। চলন্ত ট্রাক লোকটিকে চাপা দিয়ে চলে যায়। ঘটনা স্থলেই ডেড। রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই অটো সে মোটেই পছন্দ করে না। কিছুদিন আগে মুক্তির মোড়ে অটোর ধাক্কায় মাইক্রোবাসের নিচে পড়ে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ভদ্র লোক অফিস শেষ করে বাইকে বাড়ী ফিরছিলেন। মুক্তির মোড়ে আসতেই হটাৎ একটি অটো তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পিছন থেকে মাইক্রোবাসটি তাকে চাপা দেয়, জায়গায় ডেড। যেন কোন নিয়ম কানুন নেই, বিচারও নেই।
এ মোড় ঘুরেই চকদেব পাড়ায় পুকুর পাড়েই তার বাসা। বর্ণা হয়ত রেডি হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সময়ও যেন দ্রুত ছুটে চলেছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। জটলা ছাড়তে যে সময় লাগবে তার থেকে নেমে হেঁটে যাওয়াই ভালো। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজন যতক্ষণ তামাশা দেখছে ততক্ষণে তাদের হসপিটালাইজড করা যায়। রোহান এসবের কোন অর্থ খুজে পাই না। সে রিক্সা থেকে নেমেই সোজা হাঁটা শুরু করে। মিনিট ছ’য়েক লাগে তার বাসায় পৌঁছাতে। গিয়ে দেখে বর্ণা রেডি হচ্ছে। মনে মনে সে হাপ ছাড়ে, যাক বাঁচা গেল। বের হওয়ার আগে সে একটু ফ্রেস হওয়া যাবে।
আজ দুপুরে সে কোল্ড কফি খেতে চেয়েছে। রোহান সিদ্ধান্ত নিল বর্ণাকে নিয়ে প্রথমে কফি খেতে যাবে, এতে করে সে হয়ত একটু সহমর্মীতা পাবে। বাসা থেকে বেরিয়েই তারা একটি রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পাশে বর্ণা বসে আছে কিন্তু সেদিকে রোহানের কোন খেয়ালই নেই। পকেটের অবস্থা ভেবে সে শঙ্কিত। এই মূহুর্তে তার যে অবস্থা, সে প্রতিটি দিন কিভাবে পার করবে সেটা নিয়ে চিন্তত থাকে।
রিক্সা তাদের নিয়ে সরিষাহাটির মোড় ঘুরে সোজা মেইন রোড় ধরে পুরাতন বাসস্টান্ড দিয়ে এগোতে থাকে। এই জায়গাটার নাম পুরাতন বাস স্টান্ড হলেও এখানে এখন কোন বাস পাওয়া যায় না। অতীতে কোন এক সময় এখানে বাস স্টান্ড ছিল, সেই নামেই এখনও চলে আসছে। নামে কি আর আসে যায়। হঠাৎ রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে যায়, মামা কই যাইবেন? তার হুশ ফিরে। সে হাত বাড়িয়ে ইশারা করে সামনে বামে আগরওয়াল সিটিতে দাঁড়াতে বলে।
সে রিক্সা থেকে নেমে বর্ণাকে নিয়ে একটি কফি শপের দিকে এগোতে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে বর্ণাকে সে কি ভাবে ম্যানেজ করবে, এটাই সুযোগ। সে বুঝতে পারে বর্ণার এই ব্যাপারে এলার্জি আছে। এটা অবশ্যই রোহানই উস্কে দিয়েছে। কিছু দিন যাবৎ তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। প্রথমে হোমিওপ্যাথি ঔষুধ খাইয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। তার অফিসের একজন গ্রাহক আছেন যারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ডাক্তার। সে সুবাদে তাঁদের সঙ্গে রোহানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। দু’দিন আগে তাঁর সঙ্গে আলাপকালে সে বর্ণার ব্যাপারে শেয়ার করে। তিনি চেম্বারে যাওয়ার জন্য বলেন। তিনি ধারণা করছেন বর্ণার হিমোগ্লোবিনের সমস্যা রয়েছে। এখন এটা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে ব্লাডের কয়েকটি টেস্ট করতে হবে। কিন্তু বর্ণা সে ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয়। সে যেন বিরক্তি বোধ করে, সেন্টিমেন্টাল হয়ে যায়। রোহান তাকে আজও এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। সে বর্ণার ব্লাড টেস্টটা করাতে চায়।
বর্ণার ব্লাডে যে সমস্যা তা অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার সমস্যা। যার কারণে লাল রক্ত কণিকার উৎপন্ন কমে যায়। এটা বংশগত না অর্জিত তা নিশ্চিত নয়। তবে রোহানের ধারণা এটা অর্জিত, বংশগত নয়। হরমোনের অস্বাভাবিকতার জন্যও বর্ণার এ সমস্যা হতে পারে। যে কারণে তার বুক ধড়পড় করে, ত্বক শুস্ক হয়ে যাচ্ছে।
কিছু দিন আগে এটা নিয়ে বাসায় কথা হয়। তখন বর্ণা তাকে জানায় তার শরীরে রক্ত কম তৈরি হয়। কোথাও কেটে গেলেও নাকি রক্ত বের হয় সামান্যই। রোহান শুনে বিষ্ময় প্রকাশ করে। সে বলে, কি বলছ, এটা তোমাদের হলে মানায়? আমরা গ্রামের মানুষ, পুষ্টিকর খাবার দাবার সময় মত পাইনি। তোমরা তো বড়লোক মানুষ, তোমাদের তো তেমন কোন সমস্যা থাকার কথা নয়, তাহলে এমন হবে কেন? একথা গুলো বর্ণা ভালো ভাবে নেইনি। তার সেন্টিমেন্টে লাগে। সে ওভার রিএ্যাক্ট করে। সে জন্যই ব্লাড টেস্টের ব্যাপারে বর্ণার এলার্জি কাজ করছে।
অবশ্যই রোহান সেদিন নিছক মজার ছলেই কথা গুলো বলেনি। মুলতঃ বর্ণাই তাকে কথা গুলো বলতে বাতলে দিয়েছিল, জন্য সে কথা গুলো বলে। তার প্রতিটি কথাবার্তা, আচার আচারণে নাক উচু উচু ঠাট বজায় রাখে। সেটা রোহানের সব সময় ভালো লাগে না। বিশেষ করে ফাস্টফুড, স্নাক্স বা অন্যান্য রিসফুডে রোহনের আগ্রহ বরাবরই কম। বর্ণা আবার তিন বেলাই রিসফুড়ে পার করে দিতে পারে। ছোট বেলা থেকে তারা অভ্যস্থ। এটা বর্ণার পরিবারিক ঐতিহ্য বলে সে গর্ভবোধ করতেও দ্বিধান্বিত হয় না। বর্ণা তো একবার তাকে প্রশ্ন রেখেছিল, তোমরা গ্রামে বড় হয়েছ, এগুলো খেতে অভ্যস্থ হবে কিভাবে? এভাবে বলাতে সেদিন রোহানের খুব খারাপ লেগেছিল। সে কোন উত্তর দেয়নি। আসলে সেও চাইলে খেতে পারে কিন্তু এড়িয়ে চলে। তাই তো রোহান সুযোগ বুঝে বর্ণাকে এলার্জিক কথাগুলো বলেছিল।
কফি শপে ঢোকার আগে প্রথমেই বাম পাশে সারি সারি কয়েকটি জুয়েলারী দোকান, ডানে মহিলাদের শাড়ীর শো’রুম, ছেলেদের জন্য জেন্টস পার্ক, বেবীদের বিভিন্ন আইটেমের শো’রূম। দেখেই বর্ণা বলে, আসো একটু দেখে আসি, রোহান মৃদু হেসে হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ে। যদিও পকেটের কথা ভাবলে তার বুকের ভিতর দুর দুর করে কম্পন উঠে যায়।
দ্বিতীয় দোকানে ঢুকেই বর্ণা কানের দুল দেখতে চাই, রোহান চুপচাপ তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। শোরুমের ছেলেটা ঝপাঝপ অনেকগুলো কানের দুল বের করে দেয়। বর্ণা একটার পর একটা দেখেই যাচ্ছে। বর্ণা এক জোড়া কানের দুল পছন্দ করে। সে তার স্বভাব সুলভ বাচন ভঙ্গি দ্বারা বলে, ভাল বাট এগুলো এমন কেন? বলার পর সে আবার বলে, কেমন কেমন যেন লাগছে। অনেকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সে দাম জিজ্ঞেস করে। সে এমন ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে যেন এগুলো তার কাছে কিছুই নয়। তার ভাব খানা দেখে শো’রুমের ছেলেটি যে নিরাশ হল তা রোহান বুঝতে পারে। ছেলেটি নিরাশ হলেও রোহান মনে মনে স্বস্তির নিঃশ^াস ছাড়ে। তার মানিব্যাগের স্বাস্থ্য তো বর্ণা জানে না, জানার কথাও নয়।
বর্ণার বাচন ভঙ্গি এমন যে, তার কথা শুনলেই যে কেউ ধারণা করতে পারে, সে কোথা থেকে, কোন পরিবার থেকে এসেছে। এজন্য রোহানকে রিক্সা ভাড়া থেকে শুরু করে প্রতি কেনাকাটায় অতিরিক্ত মূল্য চোকাতে করতে হয়। তার কিছুই বলার থাকে না। প্রতিদানে সে দুইটা জিনিসই পায়, বাড়তি সম্মান আর সেবার আদিখ্যেতা। দ্বিতীয়টা রোহানের স্বান্তনা। প্রথমটার জন্য সে আরও অস্বস্তি বোধ করে। প্রথমটার যোগ্য বর্ণা হতে পারে, সে নয়। অবশ্যই রোহান মনে করে এটা বর্ণার ছিনালি মাত্র।
রোহান মনে করে অতিরিক্ত সম্মান বা মর্যাদা কোনটার যোগ্য সে এখনও হয়ে উঠেনি। কারণ রোহান এখনও তার ঘর তথা পরিবার গোছানোর পর্যায়েই রয়েছে। সামাজিক চাহিদা তাকে এখনও তাকে ছুঁতে পারিনি। সে অব্রাহাম মাসলোর চাহিদার ২য় স্তর ঝধভবঃু ঘববফং এ অবস্থান করলেও বর্ণা সেখানে চতুর্থ স্তর ঝড়পরধষ ঘববফং এ অবস্থান করতে চাইছে। আর এখানেই মনস্তাত্বিক সংঘাতের অর্šÍনিহিত কারণ বিদ্যমান।
দোকানের ছেলেটি সুমিষ্ট ভাষায় বর্ণার প্রশ্নের উত্তর করে যায়, একটার পর একটা দাম বলে যায়। তার কথা অবাক হওয়ার মত, একটা শোরুমের অল্প শিক্ষিত একজন মানুষের ঈড়সসবৎপরধষ ইবযধাব রোহানকে একটু চমকে দেয়। সামান্য শিক্ষিত অথচ কি আচার্য ব্যবহার, বাচন ভঙ্গী ও উপস্থাপনায় যেন শৈল্পিক জ্যোতি ঠিকরে পড়ছে। রোহানের আগ্রহ যেন আরও বেড়ে গেল। দাম জানার পরে বর্ণার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে। সে বিষ্ময়ের স্বরে বলে, ভাইয়া কি বলেন? এগুলো সোনার না? বর্ণা মনে হয় আরও বেশী দাম প্রত্যাশা করেছিল।
-না আপু, এগুলো ইমিটেশন। বর্ণা যেন এমন উত্তর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে বলে, ভাইয়া আমি তো সোনার মনে করেছি। বলেই সে ঘুরে দাঁড়ায়। রোহান বুঝতে পারে বর্ণার দম ফুরিয়ে এসেছে।
সে ছেলেটির দিকে কৃতজ্ঞতা সূচক হাসি দিয়ে বিদায় নেয়। রোহান কোন কথা বাড়ায় না। বেরিয়ে বর্ণা পাশে শাড়ীর শোরুমে ঢুকে। সে কয়েকটা শাড়ী দেখে রোহান কে জিজ্ঞেস করে, এই শাড়ীটা আমাকে কিনে দিবে? আগের শাড়ী পরে আমাকে একেবারেই মানায় না। রোহান মৃদু হাসি দিয়ে হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ে কিন্তু নিরব থাকে। সে ভাবছে বর্ণাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে। কিভাবে ভাবে তাকে ডাক্তারের কাছে নিবে, সে কি রিয়াক্ট করতে পারে, এসব সাত-পাঁচ ভেবে ভিতরে ভিতরে সে অস্থির হয়ে উঠছে। কেন না ব্যাপারটা নিয়ে কিছুদিন আগেই কথা বলার সময় বর্ণা খুব বাজে একটা রিয়াক্ট করেছে।
শঙ্কা আর আতংঙ্ক ভর করে আছে রোহানের মধ্যে, সে মনে মনে একটু স্বস্তি পেল এই ভেবে যে, যাক দুটো শোরুমে কিছুটা সময় পার করায় নিজেকে একটু প্রস্তুত করার সময় পাওয়া গেল। শাড়ীর শো’রুম থেকে বের হতে বের হতে রোহান জিজ্ঞেস করে, কি খাবে?
-কি খাব, চল গিয়ে দেখি।
-চল, কিছু খেয়ে আপার সঙ্গে দেখা করে আসি।
-কোন আপা? রোহান কথাটা শেষ না করতেই বর্ণা থমকে দাঁড়ায় এবং জিজ্ঞেস করে।
-ওই যে ডাক্তার আপা।
-কেন?বলেই বর্ণা এমন ভাবে রোহানের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন এমন পরিস্থিতির জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
রোহান নিজেকে সামলে নিয়ে বর্ণার সামনে ঘুরে দাঁড়ায় এবং বলে, এই ব্লাডের হিমোগ্লোবিন টেস্টের ব্যাপারে। রোহান ইতস্থ বোধ করে। কথাটা শেষ না হতেই বর্ণার দিকে তাকানোর উপায় থাকে না। তার মুখখানা মূহুর্তের মধ্যে ঝলসানো রুটির মত হয়ে যায়। রোহান কোন কথা বাড়ায় না।
কফি সপে ঢুকে কর্ণারের নির্জন জায়গায় একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে রোহান একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। বর্ণা তার পিছনে পিছনে এসে দাঁড়ায়। সে এমন ভাবে দাঁড়ায় যেন থমকে আছে। রোহান ইশারা করে তাকে বসার অনুরোধ করে। কয়েক মুহুর্তের নিরবতা ভেঙ্গে বর্ণা বিরক্তিকর কন্ঠে বলে, আমি কিছুই খাব না। বলেই সে গট গট করে বেরিয়ে যায়।
রাতে খাওয়ার টেবিল থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত হা-হু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাদের কথোপকথন। ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসপত্র কেমন যেন আবেগঘন চাহনিতে চেয়ে আছে। পুরো ঘরটাই আবেগের ঘন ছায়ায় পরিপূর্ণ। হয়তবা এটাই স্বাভাবিক। ঘরের প্রাণ দুটো মানুষই যেখানে নি®প্রাণ, সেখানে ঘরটা প্রাণহীন আবেশে পরিপূর্ণ হবে এটাই তো বাস্তবতা।
সকাল বেলা বাসার সামনে অনেক লোকের জটলা, কেউ কেউ মাতবারের ভুমিকাতে আছে, আবার কেউ কেউ নিরব দর্শক মাত্র। রোহানও নেমে গিয়ে নিরব দর্শকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। সে এক একজনের প্রতিক্রিয়া দেখছে। বেশ মজা পাচ্ছে এবং বেশ উপভোগ করছে। বাড়ীওয়ালাও ছিলেন, মাত্র চলে গেছেন। তার বাড়ীর দ্বিতীয় তলার এক ভাড়াটিয়া ঘরে চুরি হয়েছে। জানালা দিয়ে চোর মোবাইলসহ কিছু জিনিষপত্র চুরি করেছে। তিনি গরম গরম বক্তব্য দিয়ে থানায় গেছেন, ব্যবস্থা তো নিতেই হবে। হাজীর বাড়ী চোর! তিনি সরকারের বড়কর্তাও ছিলেন। টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদও ঢের আছে। হাজী বললেই এলাকার সকলেই তাকে এক নামে চিনে। মসজিদ মাদ্রাসায় তিনি দান খয়রাতও নিহাত কম করেন না। প্রতি বছর কত কত জাকাত দেন। তার বাড়ী চুরি, সে তো ইজ্জতের ব্যাপার!
হাজী সাহেব যাকে চোর বলে সন্দেহ করছেন তাদের পক্ষের কেই একজন বলে, আমি এইহানে ছত্রিশ বছর। সে যে বড় বড় বয়ান করে যায়, সেই ভালোনি, সেও তো বড় চোর, এত ট্যাকা কনে পাইছে? এহন হাজী হইচে!
নতুন চার তলা বাড়ী। আধুনিক ডিজাইনের নান্দনিক সৌন্দার্যে বাড়িটি করেছেন। তার দুটি মেয়ে রয়েছে। তিনি কৃষি বিভাগে চাকুরী করতেন। বছর তিনেক হল অবসরে গেছেন। এই বাড়িটি ছাড়াও তাঁর আরও জমি-জায়গা, বিষয় সম্পত্তি রয়েছে, টাকা কড়িও অঢেল রয়েছে। এলাকায় প্রচলিত রয়েছে কৃষকের বীজ আর সার চুরির টাকায় নাকি এতসব করেছেন।
এলাকার সিটকে চোর কামাল, যদিও কালু নামেই পরিচিত। সে ছোট খাটো চুরির কাজ করে। এলাকার সকলেই তাকে চেনে, তার অত্যাচারে পাড়ার সকলে অতিষ্ট হলেও কেউ কিছু বলে না। থানা পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও আবার ক’দিন পরে বেরিয়ে আসে। পাছে আবার বড় কোন ক্ষতি করে দেয় সে ভয়ে সকলেই নিঃশ্চুপ থাকে।
কালুর বাপ চায়ের দোকান আছে, কালুও তার বাপের সাথে চা বিক্রি করত। কালুকে সবাই চিনে। তার সাথে কথা বললে কেউ বলবে না সে চোর। মানুষের বিপদে আপদে সে ছুটে আছে। সে একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, সে ঘরে একটি ছেলেও রয়েছে। ছেলেটা হবার পরে আরেকজনের সাথে তার বউ পালিয়ে যায়। তার পর থেকে সে খারাপ ছেলেপেলের সাথে মিশে নেশায় জড়িয়ে পড়ে।
বর্ণার কাছে কাজের খালা এসব গল্প করেছে। অতি আশ্চার্য এক মিডিয়া এই কাজের খালারা, তাদের কাছে পাড়া মহল্লার প্রতিটি ঘরের খবর পাওয়া যায়। যা সরকারের কোন গোয়েন্দা সংস্থাও হয়ত দিতে পারবে না। তাদের বাসায় ঢোকার দুইটা বাড়ির আগের বাড়িতে এক ভদ্রলোক থাকেন। সরকারী কলেজের শিক্ষক তিনি, নাম রশিদুল হক। ভদ্রলোক তিন ছেলে মেয়ের জনক। তিনি এক হোমিও ডাক্তারের থেকে বিশেষ সমস্যার জন্য ঔষুধ খান। একদিন যাওয়া পথে বর্ণা হক সাহেবকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলে, জানো, ঐ ভাইয়া নাকি ওটার জন্য হোমিও ঔষুধ খায়। রোহান শুনে শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বর্ণা বলে, কি বল, এসব কোথায় পাও?
-আরে রাগো কেন, আমি কোথায় পাব? লামিয়াই তো বলেছে। রোহান কোন কথা বাড়ায় না। সে শুনে অবাক হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, লামিয়াকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না, তলে তলে এতোদুর! এখন থেকে আরও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। লামিয়াদের কাছে মহল্লার প্রতিটি ফ্লাটের, প্রতিটি পুরুষ কেমন চরিত্রের সে খবর থাকে। কোন পুরুষ কোন ঘাটে জল খায়, কোন মহিলা কখন কোন ঘাটে জল আনতে যায় সব, সব খবরই তারা রাখে।
হাজী সাহেব প্রথমে এই শহরে এসে বাসে হেলপারের কাজ করেছেন। তাঁর পরে কন্ট্রাকটার হন। একদিন এক ভদ্রলোক একটি ব্যাগ বাসের মধ্যে ফেলে যান। যে ব্যাগে মূল্যবান কাগজপত্র ও টাকা পয়সা ছিল। সে ব্যাগটি অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেন। লোকটি তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিয়ে বাড়িতে যান, এই সম্পর্কের ভিত্তিতে ভদ্রলোক যোগাযোগ করে চাকুরীটা দিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের একটি মেয়ে ছিল, যার সঙ্গে হাজি সাহেবের বিয়েও দিয়েছিলেন। বাচ্চা হওয়ার সময় সে বউ মারা যায়। বাচ্চাটি তিনি একটি এতিমখানায় দিয়ে দেন। হাজী সাহেব অনেক সম্পত্তির মালিক বনে যান। তাঁকে মাঝে মধ্যে এলাকায় দেখা যায় না, কোথায় হারিয়ে যান কেউ কিছু বলতে পারে না। অনেকের ধারণা তিনি সেই ছেলের কাছেই যান।
এই বাড়ীর মালিক হাজী সাহেবের স্ত্রী। তিনি বেশ গর্বের সঙ্গে গল্প করেছেন, আপনার ভাই আমাকে এই বাড়িটি লিখে দিয়েছেন। কী স্ফীত তৃপ্তিময় এক হাসি, এ যেন জীবন্ত মমতাজ!পরে কাজের খালা বর্ণাকে তাঁর সব পুরাণ পাঠ চুকিয়েছে।
আগে তাঁরা গাজা সোসাইটিতে থাকতেন। কোন কাজের মহিলা নাকি বেশিদিন কাজ করতে পারত না, এটা নিয়ে প্রায়শ ঝামেলা হত। পরে এখানে এসে বাড়ী করেন। বাসার নিচতলায় গ্যারেজের পাশে একটি রুম রয়েছে, যার চাবি হাজী সাহেবের নিকটেই থাকে। এটি হাজি সাহেবের নিজস্ব রুম। বন্ধু বান্ধব আসলে এখানে বসে তিনি আড্ডা দেন। জরুরী কাজে বাইরের কেউ আসলে এই রুমেই আলোচনা সারেন।
হাজী সাহেবের স্ত্রী জানতে পারেন, মাঝে মাঝে এই রুমে বাহিরের মহিলারা আসে। স্ত্রী তাঁকে চোখে চোখে রাখেন এবং ঠিকই একদিন জায়গামত তাঁকে ধরে ফেলেন। হাজী সাহেবের তখন বেহাল দশা। তাঁর স্ত্রীর সাফ কথা আত্নহত্যা করবেন। তিনি মুখ দেখাবেন কিভাবে। মামলা, জেল, চাকুরী হারানো ইত্যাদি কত কিছুই তাঁর সামনে উঁকি দিতে থাকে। তখন তিনি স্ত্রীর নিকটে মুচলেকা দেন, এহেন কাজ জীবনে আর করবেন না। আর স্ত্রীর বাড়তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা স্বরূপ বাড়ীটি তাঁর নামে লিখে দেন।
রোহানও হাজী সাহেবকে দেখতে পারে না। তারা এ বাড়িতে যখন নতুন এসেছে, হাজী সাহেব প্রথম দিকে প্রায়ই বিভিন্ন বাহানায় নক বাসায় করতেন। প্রথমে বর্ণা ভিতরে ঢুকতে দিলেও পরে সে বলে দেয়, আপনার কিছু বলার থাকলে আপনার ভাইকে বলেন, যখন তখন নক করবেন না। আমি একা থাকি, আমার অনেক কাজ থাকে। এর পরেও একদিন সে নক করে। বর্ণা রোহানকে ফোনে সেটা জানায়। রোহান তাকে ফোন দিয়ে সরাসরি বলে, কী ব্যাপার ভাই, যখন তখন বাসায় নক করেন কেন? কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারতেন।
-না, কি বলেন ভাই?
-কি বলি মানে?
-আরে আমি যাচ্ছিলাম, ভাবলাম বিদ্যুৎ বিলের কাগজটা দিয়ে যাই।
-পরেও তো দিতে পারতেন।
-ভাবি যে এটা নিয়ে মাইন্ড করবে বুঝি নাই।
-মাইন্ড করার কিছু নাই, একা একটা মেয়ে মানুষ বাসায়, সে ভয় পায় বোঝেন না?
-আচ্ছা আপনি আসেন, কথা হবে।
-ঠিক আছে।
অফিস থেকে এসে ফ্রেস হয়েই রোহান আর বর্ণা সোজা চলে যায় তার বাসায়। তিন তলার সম্পূর্ণ ফ্লোর নিয়ে তিনি থাকেন। বাসার এক পাশে টবে বিভিন্ন প্রকার ফুলের গাছ আছে, তার পাশে খাঁচায় বিভিন্ন প্রজাতির বাহারী রংয়ের পাখিও রয়েছে। তাদের দেখেই ভাবি বললেন, এই কি ব্যাপার, দু’জন এক সাথে। আপনারা তো আসেনই না।
-আসব আসব করি ভাবি, সময় হয় না।
-হুম, বাচ্চা কাচ্চা নেই, দু-তলা থেকে তিন তলায় আসার সময় হয়না?
-ভাই কই ?বর্ণা বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে।
-আছে ভিতরে, আরে ভাই বসেন, দাঁড়িয়ে কেন? বলেই ভাবি রোহানকে বসতে বলে।
-ভাই কে একটু ডাকবেন প্লিজ, বলেই রোহান না বসে পাখির খাঁচার কাছে গিয়ে পাখি দেখতে থাকে।
-ডেকে দিচ্ছি। বসেন, আমি একটু নাস্তা নিয়ে আসি। বলেই ভাবি ভাইকে ডেকে দিয়ে কিচেনে যায়।
কিছুক্ষণ পরে হাজী সাহেব আসলেন। তাকে বেশ বিব্রত দেখাচ্ছে। সত্যিই যে তারা আসবে তিনি হয়ত সেটা আশা করেননি। রোহান তাকে আসতে দেখে ছালাম দিয়ে বর্ণার পাশে বসে।
-কি ব্যাপার ভাই, এসেছেন আপনারা?
-হুম।
– কি বলেন, রাগঢাক কিছু না, সরাসরি বলেন।
-ভাই আমি বলি শোনেন, আপনার ভাই বলবে না, আমি বলছি।
-হুম বলেন, তার কথায় টানটান ভাব।
-শোনেন আপনি আমাদের কি মনে করেন? শোনেন আপনার বাসায় ভাড়া থাকি বলে কি মনে করেন যে আমাদের কিছু নাই?
-ছি ছি ভাবি কি বলেন!
-হুম, আপনার ভাবসাব দেখে মনে হয় তাই। আমাদের গ্রামেও বাড়ী আছে, রাজশাহী শহরেও বাড়ী আছে। আমাদের বাড়ীতেও ভাড়াটিয়া থাকে। আমার বাপ চাচারা কিন্তু এমন করে না। কোনদিন উকিও দিয়ে দেখে না। ঢাকার বাড়ীতেও ভাড়াটিয়া থাকে। আপনি কি বোঝাবেন আমারে? সবই বুঝি। বর্ণা কথাগুলো হড় হড় করে বলে যায়। তারে দেখে বোঝা যাছে সে জমানো ক্ষোভটা উগরে দিল, সে যেন ফেঁটে বেরুতে চাইছে।
হাজী সাহেব কোন কথা বলেন না। মাথা নিচু করে বসে আছেন। তাঁর স্ত্রী রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সবই শুনল। সে দাঁত কটমট করে হাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। পারলে তাঁকে ছিড়ে খাই। হাজী সাহেব দেখেই মুখ কাচুমুচু করে বলেন, ভাবী সমস্যা নেই, আপনারা আপনাদের মতই থাকেন। আমার একটু কাজ আছে, আমি আসছি। বলেই হাজী বেরিয়ে গলেন। এর পরে হাজী সাহেব আর কোন দিন তাদের ফ্লাটের চৌকাঠও মাড়াননি।
Title: তৃতীয় পৃথিবীতে
Author: সালমান পারভেজ সবুজ
Publisher: রয়েল পাবলিকেশন
আরো পড়ুনঃ তৃতীয় পৃথিবীতে (পর্ব-০২)
Leave a Reply