উজ্জ্বল মাহমুদ, কুষ্টিয়া : গ্রাম বাংলার কাচারি ঘর এখন বিলুপ্তির পথে।কালের বিবর্তনে হারাতে বসেছে এ কাচারিঘর। এক সময় গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে কাচারি ঘর ছিল। বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এই ঘরটি কাচারি ঘর বা বাংলা ঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিল। কাচারি ঘর স্থাপিত হয় বাড়ির সামনে ঘাটায়। এতে বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ায়। অতিথি, পথচারী, মুসাফির, সাক্ষাৎ প্রার্থী ও বাড়ির ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার ঘর হিসেবে ব্যবহার হতো।
সব সময় থাকতো বেশ জমজমাট।
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাচারি ঘর সচারচর তেমন চোখে পড়ে না। আধুনিকতায় বদলে গেছে গ্রামের সেই দৃশ্যপট। দিন দিন মানুষ বৃদ্ধির পাশাপাশি এলাকায় দৃষ্টি নন্দন বাড়িঘর তৈরি হওয়ায় কমে আসছে জায়গার পরিমাণ। কিন্তু কালের বিবর্তনে কুষ্টিয়া জেলায় প্রায় ংবিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও কালচারের অংশ কাচারি ঘর। এখন আর সহসায় চোখে পড়ছে না কাচারি ঘর। নব্বই দশকের আগেও গ্রামাঞ্চলের অনেক শৌখিন বাড়িতেই কাচারি ঘর ছিল।
গ্রামের একাধিক প্রবীণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় গ্রামাঞ্চলে অবস্থাসম্পন্ন অনেক সৌখিন গৃহস্থের বাড়িতে কাচারি ঘর ছিল। চারিদিকে ঢেউ টিনের বেড়ার সঙ্গে কাঠের কারু কাজ উপরে টিন অথবা ছনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হতো। যা অতি প্রাকৃতিক বান্ধব পরিবেশ দিয়ে আবেষ্টিত ছিল। তখনকার যুগে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকলে কাচারি ঘর ছিল আরামদায়ক শীতল পরিবেশ। তীব্র গরমেও কাচারি ঘরের খোলা জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস বইতো। কাচারি ঘরে গৃহশিক্ষক ছাড়া নিয়মিত সালিশ-বৈঠক, সামাজিক অনুষ্ঠান বিয়ে, গল্প-আড্ডা, পথচারী ও মুসাফিরদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
অনেক স্থানে বর্ষা মৌসুমে গ্রামের লোকজনদের উপস্থিতিতে কাচারি ঘরে পুঁথি পাঠ ও জারি গানের আয়োজন করা হতো। গ্রামাঞ্চলের লোকজন কোন সময় রাত-বিরেতে নদী পারাপারের জন্য বিলম্ব হলে তারা তখন সারা রাত গ্রামের যে কোনো কাচারি ঘরে মুসাফির হিসেবে কাটিয়ে দিতো এবং পরের দিন তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতো। তবে কাচারি ঘরে অবস্থানকালে মুসাফিরদের আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোন ত্রুটিই ছিলো না।
উপজেলার গোপালপুর গ্রামের জোয়াদ আলীর ছেলে রেজাউল করিম বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে কাচারি ঘর দেখেছি।দাদা, বাবা-চাচাদের কাছে নিয়মিত এলাকার অনেক লোকজন আসতো। তারা কাচারি ঘরে বসে সামাজিক সমস্যা সমাধান দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সামাজিক নানা ধরনের অনুষ্ঠান করতেন। সব সময় কাচারি ঘরটি জমজমাট থাকতো। এক পর্যায়ে লোকজন বেড়ে যাওয়ায়, বণ্টনে জায়গা কমে আসায় আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাড়িঘর তৈরি হওয়ায় কাচারি ঘরটি আর রাখা যায়নি।
উপজেলার উজানগ্রাম এলাকার আঃ রাজ্জাক বলেন, আমাদের বাড়িতে একটি কাচারি ঘর ছিল। সব সময় জমজমাট থাকতো। বাড়িতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জায়গা কমে গেছে। বসতবাড়ি তৈরি করতে গিয়ে কাচারি ঘরকে রাখা সম্ভব হয়নি।
উপজেলার উজাগ্রাম ইউনিয়নের সোনাইডাঙ্গা এলাকার টিটু বলেন, ছোট বেলা থেকে আমাদের বাড়ির সামনে একটি কাচারি ঘর দেখে আসছি, এখন সেটি বিদ্যমান আছে তবে বর্তমানে এই ঘরটি জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকলেও এটি এখন কৃষি ব্যবহার জিনিসপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই সময় থেকে এখানে সামাজিক দেনদরবারসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে।
বর্তমানে চারদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় গ্রাম বাংলার কাচারি ঘর এখন বিলুপ্ত প্রায়।
তিনি আরো বলেন, তৎকালীন সময় সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দু ছিল কাচারি ঘর ঘিরে। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে সামাজিক সালিশ বৈঠকসহ নানা বিষয় স্থানীয় ক্ষমতাসিনদের হাতে চলে আসায় কাচারি ঘর আর ব্যবহার না হওয়ায় ঘরটি এক পর্যায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।