মুফতি ইসমাঈল বিন সাঈদ: ‘মীলাদ’ একটি আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ জন্ম। ‘মীলাদুন্নবী’ বলতে আমরা বুঝি, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বা জন্মদিবস। মীলাদুন্নবী বা নবীজির জন্মদিনকেন্দ্রিক যে সকল উৎসব পালন করা হয়, সাধারণত আমাদের দেশে তাকে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ বলা হয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীকে পরিভাষায় বলা হয় ‘সীরাত’। জন্ম- আলোচনা যেহেতু নবীজীবনেরই একটি অংশ-বিশেষ তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটিও সীরাতেরই অংশ। আর তাকে সহজে ‘সীরাতুন্নবী’ বলা হয়।
মীলাদের উৎপত্তি – রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ, পরবর্তী সাহাবী, তাবিয়ীন এবং সালফে সালিহীনের যুগসহ খাইরুল কুরুনের কোন যুগেই ঈদে মীলাদুন্নবীর কোন অস্তিত্ব ছিল না। ক্রুসেড বিজেতা, মিসরের সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ, কর্তৃক নিযুক্ত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্নর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরী সর্বপ্রথম ৬০৪ হিজরীতে, মতান্তরে ৬২৫ হিজরীতে মীলাদের প্রচলন ঘটান। যা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর ৫৯৩ বা ৬১৪ বছর পরে। হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. এ প্রসঙ্গে বলেন,, সবচেয়ে বড় ভুল হলো ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামক অনুষ্ঠানটির আবিষ্কার। এটি এক মুসলিম বাদশাহর খেয়ালী আবিষ্কার। তিনি খ্রিষ্টানদের বড় দিনের বিপরীতে এই মীলাদুন্নবীর আয়োজন করেন। তার ধারণা ছিল তারা যেমন বড় দিন (যীশুখ্রিষ্ট্রের জন্মদিন) পালন করে আমরাও আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন পালন করবো, কিন্তু এটি তার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। (ঈদে মীলাদুন্নবী কি শরয়ী হাইছিয়াত: ৫৭)
কিছুকাল ধরে এশিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্রে – একশ্রেণীর মানুষ ১২ই রবিউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব পালন করে আসছে। এই উৎসবকে মীলাদুন্নবী বা ‘সাইছ্যিদুল আইয়াদ’, ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ’ বা ‘বড় ঈদ’ বলে নামকরণ করা হচ্ছে। বহু ধুমধাম ও জাঁকজমকের সাথে, আলোকসজ্জা করে, হালুয়া-মিষ্টি খেয়ে তা উদ্যাপন করা হয়। পাশাপাশি এসব অনুষ্ঠান উদযাপনকে নবীপ্রেমের শ্রেষ্ঠ আলামতরূপে আখ্যায়িত করে তার প্রতি বিশেষ তাগিদ ও উৎসাহ প্রদান করা হয়। এবং যারা এতে অংশগ্রহণ করে না তাদের অন্তর নবীপ্রেম- হীন বলে মনে করা হয়। অথচ তাদের এই দাবী সম্পূর্ণ অসত্য। কারণ, আসলেই যদি ঈদে মীলাদুন্নবী নামের কিছু শরীয়তে থাকত এবং তা পালন করা নবীপ্রেমের নিদর্শন হতো তবে ।
প্রথমত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের অন্য সব মৌলিক বিষয়ের মত এই আমলটিও অন্যদের শিক্ষা দিতেন। এবং আমল করতে বলতেন।
দ্বিতীয়ত, সাহাবায়ে কেরাম রা. যারা সবচেয়ে বেশি আশেকে রাসুল ছিলেন, নিজের পরিবার, সমাজ, বিত্ত-বৈভব সবই বিসর্জন করেছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বতে তারা অবশ্যই তা পালন করে দেখাতেন। অথচ এ সকল বিষয় সাহাবায়েকেরাম থেকে প্রমাণিত নয়। খুলাফায়ে রাশেদীন তথা আবু বকর রা., ওমর রা., উসমান রা. ও হযরত আলী রা. এর যামানায়ও এই ঈদ উদ্যাপিত হয়নি। এমনকি তাবেয়ীগণ, তাবে-তাবেয়ীগণও তা পালন করেননি।
তৃতীয়ত, কুরআন, হাদীস ও ফিকহের মৌলিক কিতাবাদীতে এই ঈদ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই নেই।এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু:৭২৮হি.) বলেন,অর্থাৎ, কিছু মানুষ খ্রিস্টানদের অনুকরণে, অথবা নবীজির প্রতি ভালোবাসার টানে বা সম্মানের জন্য নবীজীর জন্মদিনকে ঈদের দিন ধার্য করেন। অথচ আমাদের সালাফ থেকে এটি প্রমাণিত নয়। এটি যদি ভালো বা কল্যাণকর কোনো কাজ হতো, তাহলে অবশ্যই আমাদের সালাফরা তা করতেন। কারণ তারা আমাদের চাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বেশি ভালোবাসতেন। (ইকতিযাটস সিবাতিল মুস্তাকীম: ২/১২৩)
ইসলামের ঈদ শুধু দুটি – হাদীস শরীফে মুসলিম জাতির জন্য শুধু দু’টি ঈদের কথা বলা হয়েছে।
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনায় এলেন। সে সময় মদীনাবাসীর দু’টি দিবস ছিল; যে দিন দুটিতে তারা প্রতিবছর খেলাধুলার মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন করত। দিবস দুটি সম্পর্কে নবীজি জিজ্ঞাসা করলে তারা জানাল, জাহিলিয়াতের সময় থেকে আমরা দিবস দুটি উদযাপন করে আসছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এই থেকে দান করেছেন এবং তা হলো, কুরবানীর ঈদ এবং রোযার ঈদ। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ১১৩৪)
এছাড়া মুসলিম উম্মাহর ফিকহের ইমামগণও তাঁদের গবেষণা ও কিতাবসমূহে দুই ঈদ ছাড়া তৃতীয় কোনো ঈদের কথা উল্লেখ করেননি।খাইরুল কুরূন অর্থাৎ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগেও তৃতীয় কোনো ঈদের অস্তিত্ব ছিল বলে ইসলামী ইতিহাস থেকে জানা যায় না। সুতরাং এমন অস্তিত্বহীন বিষয়কে প্রথমত ঈদ সাব্যস্ত করা, দ্বিতীয়ত ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ’ বলে প্রচারণা চালানো ও উদ্যাপন করা কোনো সচেতন মুসলিমের কাজ হতে পারে না। এটি একটি পরিষ্কার বিদআত। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না।
ঈদে মীলাদুন্নবী বিদআত মর্মে ইমামদের বক্তব্য
১. আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহি, কে প্রশ্ন করা হয়, মীলাদ অনুষ্ঠান কি বিদআত? না শরীয়তে এর কোন ভিত্তি আছে? জবাবে তিনি বলেন, মীলাদ অনুষ্ঠান মূলতঃ বিদআত। তিন পবিত্র যুগের সালফে সালিহীনের আমলে এর অস্তিত্ব ছিল না। হিওয়ার মাআল মালিকী-১৭৭।
২. ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মালেকী রাহি, বলেন, “চার মাযহাবের আলেমগণ মীলাদ অনুষ্ঠান বিদআত মর্মে একমত।” আল কাওলুল মু’তামাদ ২৫৩।
৩. সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী খ্যাত শায়েখ আব্দুল আযীয বিন বায রাহি, এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কুরআন, সুন্নাহ তথা শরয়ী দলীলমতে ঈদে মীলাদুন্নবীর আয়োজন-অনুষ্ঠান ভিত্তিহীন, বরং বিদআত। এতে ইহুদী- খ্রীস্টানদের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এসব অনুষ্ঠানে মুসলমানদের যোগদান করা নাজায়েয। কেননা, এর দ্বারা বিদআতের সম্প্রসারণ ও এর প্রতি উৎসাহ যোগানো হয়।” মাজমুউল ফাতওয়া-৪/২৮৩-৮৪।
জন্মের খুশিতে ঈদ পালন নয় বরং রোযা রাখা নবীজির শিক্ষা
রাসূলের জন্মদিনে ঈদ নয় বরং ওই দিন সুন্নাহ সম্মত আমল হলো রোযা রাখা। হাদিস শরিফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি সোমবার দিন রোযা রাখতেন। তাঁকে রোযা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি’। সহিহ মুসলিম১১৬২ তাই কেউ যদি নবীজির জন্মদিন উপলক্ষ্যে কোন আমল করতে চায়, তার জন্য উচিত প্রতি সোমবার রোযা রাখা। এটিই সুন্নাহ সম্মত আমল। এর বিপরীতে প্রচলিত ঈদে মিলাদুন্নবীর কোন আয়োজনে শরিক হওয়া বেদআত। এরূপ কোন বেতআতে লিপ্ত হলে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।
শেষকথা: আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজ-কর্ম নবীজির সুন্নতের আলোকে সাজাতে হবে। মিলাদ নিয়ে মাতামাতি না করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীজির সীরাতের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। বিদআত থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। বেদআতপূর্ণ কাজে কোন ধরনের সহযোগিতা, সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যারা বিদআতে লিপ্ত তাদেরকে বুঝাতে হবে এবং তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া জারি রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে বিদআতের মতো ভয়াবহ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামীন।