দীর্ঘ আট বছর পর চোখে কাপড় বেঁধে, দু হাতে হাতকড়া পরিয়ে ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাশেমকে (আরমান) একটি গোপন কারাগার থেকে বের করল কয়েকজন। এ সময় তিনি মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। চোখ-মুখ শক্ত করে বেঁধে রাখায় তার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। এর কিছুক্ষণ পরই আরমানকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে একটি কর্দমাক্ত গর্তে ফেলে দেয়া হয়। গত আট বছরে এই প্রথম তিনি প্রকৃতির আলো বাতাসের ছোঁয়া পেলেন। তিনি মনে করেছিলেন, হত্যার উদ্দেশ্যেই তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারণ, তখনো তিনি জানতেন না যে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে তাকে মুক্তি দিয়ে এর হোতারা পালিয়ে যাচ্ছে। আর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা।
ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি’র বরাতে লুক্সেমবার্গভিত্তিক গণমাধ্যম আরটিএল আহমদ বিন কাসেমের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে। সেখানেই তিনি এসব শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার বর্ণনা দেন।
তিনি ভেবেছিলেন তারা তাকে হত্যা করবে। তিনি এটাও জানতেন না তাকে হাত, চোখ বেঁধে নিয়ে আসার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। ৫ আগস্ট ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এই দিনও গুম হওয়া আহমদ অন্ধকার সেই আয়নাঘরেই ছিলেন। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা ছাড়া ওই গোপন কারাগারের খবর কেউই জানতেন না। আরমান বলেন, বন্দী ছাড়া কারো সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় সেখানে ছিল না । দীর্ঘ আট বছর তিনি সেখানে একটি কক্ষে আটক ছিলেন। আয়নাঘর সম্পর্কে যেন কেউ কোনো তথ্য না পায় সে বিষয়ে গোয়েন্দারা কঠোর নীতি অনুসরণ করতেন।
আরমান বলেছেন, তিনি আয়নাঘর থেকে বাইরের আজান শুনতে পেতেন। সেখানে উচ্চ আওয়াজে মিউজিক বাজানো হতো। মূলত আজান শুনে শুনে দিন রাতের পার্থক্য করতেন আহমদ। তবে সেখানে তিনি ঠিক কত দিন অতিবাহিত করেছেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা তার ছিল না। মিউজিক বন্ধ হলেই তিনি অন্য বন্দীদের আর্তনাদ শুনতে পেতেন। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি সেখানে আমি একা নই। আমি সেখানে প্রতিনিয়ত অন্য বন্দীদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। সম্ভবত সেখানে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বন্দীরা চিৎকার করত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা ছয় শতাধিক লোককে গুম করেছে। ২০২২ সালে একটি গণমাধ্যমে আয়নাঘর সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত হাসিনার ওই গোপন কারাগার সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। আয়নাঘর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর হাসিনা সরকার তা অস্বীকার করেছিল। এ ছাড়া তারা গুমের বিষয়টিও অস্বীকার করে আসছিল। সে সময় বলা হয়েছিল, যারা নিখোঁজ হয়েছে তারা অবৈধ উপায়ে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন।
আরমান জানান, এক রাতে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তার পরিবারের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে তুলে নিয়ে যায়। তাকে সিঁড়ি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে একটি গাড়িতে তোলা হয়। তিনি বলেন, আমি কখনো স্বপ্নেও আমার এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা ভাবতে পারিনি। আমি বুঝতে পারিনি বাবার ফাঁসির কয়েক দিন আগে আমাকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। ‘আমি তখন বারবার তাদের বলছিলাম আপনারা কি জানেন আমি কে? মামলা পরিচালনার জন্য আমাকে বাবার ওখানে থাকতে হবে।’ আরমানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চার সপ্তাহ পর মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
আরমানকে কর্দমাক্ত নর্দমায় ফেলে যাওয়ার পর রাতে তিনি তার বাড়ির পথ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। পরে তিনি তার বাবার প্রতিষ্ঠিত একটি হাসপাতালের খোঁজ পান এবং সেখানে গিয়ে তিনি তার পরিচয় দেন। হাসপাতালটির এক স্টাফ তার পরিচয় শনাক্ত করতে পেরে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন। হাসপাতালে উপস্থিত লোকজনের কথা শুনে আরমান জানতে পারেন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলনের কথা। যার ফলে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। আরমান বলেছেন, দেশের তরুণদের কারণে আমি মুক্তি পেয়েছি। আমি যখন এই তরুণদের দেখি যে তারা দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন আমি বাংলাদেশের সঠিক গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। আরমান পরিবারের কাছে ফিরে এলেও তার মানসিক অবস্থা এখনো বিপর্যস্ত বলে জানিয়েছে তার পরিবার। আরমানকে গুম করার সময় তার বড় মেয়ের বয়স ছিল চার বছর এবং ছোট মেয়ে ছিল তিন বছরের।
নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ভিন্ন মতালম্বীদের কঠোরভাবে দমন করেছিলেন বাংলাদেশের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত নেতা শেখ হাসিনা। তার শাসনামলে গুম, খুন অনেকটাই স্বাভাবিক রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছিল। ২০১৬ সালে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেম আরমানকে গুম করা হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত হাসিনার গোপন কারাগারে। বার্তা সংস্থা এএফপিকে ৪০ বছর বয়সী আহমদ বলেছেন, আট বছরের মধ্যে তিনি কোনো প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ছোঁয়া পাননি।
আরমানের বাবা জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বছরেই হাসিনা প্রশাসন আরমানকে গুম করে। সরকার জামায়াতের ওই নেতাকে মানবতাবিরোধী অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের কথা বললেও এ নিয়ে বেশ মতবিরোধ রয়েছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, হাসিনাবিরোধী মতকে দমন করতে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মীর কাসেম আলীসহ জামায়াতের অন্যান্য নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। কাসেম আলী দোষী কি না এ বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য সেসময় আদালতের বিচারিক কার্যে কোনো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল জড়িত ছিল না। ব্যারিস্টার আরমান তার বাবার বিচারিক কার্যক্রমে আইনি লড়াই করতে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর। সেসময় ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং বিচারিক পক্ষপাতের বিষয়ে গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে উঠে আসে।
-সংগ্রহে: এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব